শনিবার, ৯ মে, ২০০৯

ডিজিটাল বাংলাদেশ - আমাদের করণীয়

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে গ্রামে গ্রামে ফ্রি ইন্টারনেট চাই


এবারের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১৫০ কোটি টাকাই হোক বা ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হোক, কিছু বরাদ্দ থাকা উচিত আইসিটি অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামের জন্য। মন্ত্রণালয় যদি মনে করে ১৫০ কোটি টাকা ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট তাহলে তাদের কাছ থেকে আমরা বড় কিছু আশা করতে পারি না। শুধু শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন করলেই চলবে না প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পৌঁছে দিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভর্তুকি দিয়ে হলেও ইন্টারনেট ফ্রি করা উচিত।
ঠেকে ঠেকে শেখা, হাতের অন্দাজে পথ খোঁজা কোনো বুদ্ধিমান জাতির কাজ নয়। আমাদের জনগণ যা বোঝেন তা যদি নীতিনির্ধারকদের বুঝতে সাত-আট বছর লেগে যায়, তাহলে এই জাতির কাছে হতাশা ছাড়া আর কিছুই রইবে না। ১৯৯৩ সালে প্রথম যখন ইমেইল সার্ভিস শুরু হয় তখন দেশের তথ্য পাচার হয়ে যাবে বলে এটি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক যেমনি ফটোকপিয়ার মেশিন আমদানির বিষয়েও একই অজুহাত দেখিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশের পথ দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। ১৯৯৪ সালে ফ্লাগ নামে বিশ্ব সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সুপার হাইওয়েতে প্রবেশ করতে পারতো কিন্তু বাংলাদেশ এতে অংশ না নিলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ঠিকই যুক্ত হয়। সেই বছরই ২৪ হাজার কোটি টাকার ডাটা এন্ট্রি কাজের জন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে ফিরে যায়। বাংলাদেশ বঞ্চিত হয় হাজার কোটি টাকার আউটসোর্সিং কাজের সম্ভাবনা থেকে। এরপর অনেক চড়াইউৎরাই পার হয়ে ২০০৬ সালে প্রায় ১২ বছর পর বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হয়। ৮০’র দশক থেকে বাংলাদেশে কম্পিউটার আমদানি হলেও তার মধ্যে আমদানি শুল্ক ছিল। যার কারণে দেশের কম্পিউটারে ব্যবহার প্রসারিত হয়নি। দেশের প্রিন্ট মিডিয়াগুলো এই বিষয়ে বার বার তাদের লেখনির মাধ্যমে কম্পিউটার শুল্ক মুক্ত করার জন্য দাবী জানায়। ’৯০-এর দশকেও যদি শুল্কমুক্ত কম্পিউটার বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কাছে আসতো তাহলে আজ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের গ্লোবাল ইনফরমেশন টেকনোলজি রিপোর্টের নেটওয়ার্ক রেডিন্যাস ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তে নামতো না। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০১১ সালে ৪০ হাজার টেলিসেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এটি আসলে অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে আইসিটি বাজেট দেয়া হয় মাত্র ২২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ১৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়। জুলাই ২০০৫ সালে বাজেটে ১০শতাংশ হারে কর প্রস্তাব করা হয়। যদিও এটি পরে বাতিল হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ২০০৭ সালে আইসিটি উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি ডলার। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো এই খাতে ব্যয় করেছে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নিম্ন আয়ের দেশগুলো যাদের মাথাপিছু আয় ৯৩৫ ডলারের নিচে তাদেরও এই খাতে ব্যয় ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ আইসিটি খাতে জনপ্রতি ব্যয় ৪৪ ডলার। ইন্দোনেশিয়া এই খাতে ৩৪ কোটি, থাইল্যান্ড ৩০ কোটি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ১৩ কোটি ডলার ব্যয় করছে। এই অর্থ মোট সরকারি বাজেটের প্রায় দশমিক ৫ শতাংশ এবং জিডিপির দশমিক শূন্য শতাংশেরও কম। ভারত সরকার আইসিটি খাতে ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়েছে। তারা এ খাতে ব্যয় করছে বাজেটের ২ থেকে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। তাই আমাদেরও এই খাতে উন্নয়ন করতে হলে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমাদের বাজেট ১৫০ কোটি হোক বা ৬ হাজার কোটি হোক, কিছু বরাদ্দ থাকা উচিত অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামের জন্য। মন্ত্রণালয় যদি মনে করে ১৫০ কোটি টাকা ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট তাহলে তাদের কাছ থেকে আমরা বড় কিছু আশা করতে পারি না। আমাদের সবাইকে মিলে একত্রে কাজ করতে হবে। তাহলে সরকারের ওপর একটা চাপ তৈরি করা যাবে। একসেস নেটওয়ার্ক এবং অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
এতে ইন্ডাস্ট্রি অরিয়েন্টেড মানবসম্পদ তৈরি হবে। বাজেটে এই দিকটায় জোর দিতে হবে। পণ্যের যে আইডিয়া তৈরি হবে তা বাস্তবায়নে ৫০ কোটি টাকা এবং মঞ্জুরি হিসেবে দিতে হবে ৫০ কোটি টাকা। সারা বিশ্বে এখন চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। এই মন্দা মোকাবেলায় সারা বিশ্ব তৎপর। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে এই মন্দার প্রভাব এখনো পড়েনি বলে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোন কারণ নেই। আমাদের এখন প্রয়োজন শিল্পতে বিনিয়োগ করা। ফিলিপাইন সরকার তাদের বিদেশ থেকে ফেরা শ্রমিকদের জন্য ভাতা প্রদান করছে এবং তাদেরকে আরো কর্মোপযোগী করার জন্য ট্রেনিং দিচ্ছে।
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ত্রিমুখী উন্নয়ন এর একটি হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক দারিদ্রতা। আর এজন্য সরকারের ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য তিন ধাপে কাজ করতে হবে। এর প্রথম ধাপ হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তিতে জনগণকে শিক্ষিত করতে হবে। সবাইকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রয়োজন নাই কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট অবকাঠামো তৈরি করতে হবে এজন্য জেলা লেভেলের পাশাপাশি কিছু কিছু উন্নত উপজেলায় ইন্টারনেট সম্প্রসারণ করতে হবে। সরকারতো কতো কিছুতেই ভর্তুকি দেয় এখন গ্রামে গঞ্জে ফ্রি ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া উচিত। সবশেষে হচ্ছে এই তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্পৃক্ত যুবকদের সুদমুক্ত ছোট ছোট ঋণ দিতে হবে। মটরসাইকেল কেনার জন্য ব্যাংক ঋণ দেয়। একটি শিক্ষিত বেকার যুবককে যদি একটি কম্পিউটার, প্রিন্টার, ক্যামেরা কেনার জন্য সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হয় তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার শপথে যে সরকার এসেছে তার কিছুটা লক্ষ্য উদ্দেশ্য বা রোডম্যাপ অন্তত প্রথম ১০০ দিনে ফুটে ওঠা উচিত ছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ না হলেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি এগিয়ে যাবে। কিন্তু সরকারের এটি প্রথম এজেন্ডা হওয়ার মানুষের আশাও বেড়ে গিয়েছে অনেকদূর। এ জন্য এরই মধ্যে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের রোডম্যাপ তৈরি করে দু’একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিলেই এর অগ্রযাত্রা মানুষের চোখে পড়তো। শুল্কমুক্ত কম্পিউটার আমরা বললেই কম্পিউটারেরই বিভিন্ন যন্ত্রাংশের উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক রাজস্ব থাকে। কম্পিউটার শুধু মাদারবোর্ড, হার্ডডিস্ক আর র‌্যাম দিয়েই হয় না। প্রিন্টারের কালি ডিজিটাল ক্যামেরাসহ বিভিন্ন পণ্যে এখনো শুল্ক অনেক বেশি। আমরা আশা করছি এই বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে সরকার আরো মনোনিবেশ করবে এবং সত্যিকারের শুল্কমুক্ত কম্পিউটার মানুষকে দিবে। ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আমরা সরকারের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি ২০২১ সালের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার তথ্য প্রযুক্তি পণ্যের উপর শুল্ক শূন্য করবে। তথ্য, যোগাযোগ ও টেলিকম সেক্টরে গত বছর সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫০০ কোটি টাকা আর এর মধ্যে ২২০০ কোটি টাকা সরকার আয় করছে। এর আগের বছর এই খাতে সরকারের আয় ছিল ১৬০০ কোটি টাকা।

1 টি মন্তব্য:

  1. প্রথমে লেখক কে ধন্যবাদ দিয়েই কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
    আসলে আমাদের দেশের নেতারা কেউ কিন্তু কোন দিনই ভালো ছাত্র ছিলেন না। আমার লেখায় কে কি মনে করল, তা দেখার সময় নেয়। সবায় রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। পাস? তা তো করতেন পুটুশ কলের জোরে (ক্ষমতার বলে)। যারা মারো ধরো করে নেতা হয়েছেন, তাদের কাছ থেকে অভাগা দেশ কি আশা করতে পারে???

    তাই, শুধু ডিজিটালই নয়, সার্বিক উন্নয়নের জন্য চাই যোগ্য পরিচালক।

    উত্তরমুছুন